নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে একই উদ্দেশ্যে সমষ্টিগতভাবে কোন একটি কাজ করাই সমবায়। এই উপমহাদেশে সমবায়ের যাএা শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে পড়াশুনা করতে গিয়ে ও রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে কৃষি সমবায়ের ধারনা লাভ করেন। তিনি এ উপমহাদেশে তা বাস্তবায়ন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করেন। তৎকালীন সময়ের তাঁর বিভিন্ন লেখায় সমবায় সম্পর্কে এ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সমবায়কে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয় চল্লিশের দশকে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে।
দেশ বিভাগের পর পুর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকারের কৃষি ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আর তখন থেকেই মুলত সমবায় নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সমবায়কে বেছে নিয়েছিলেন।স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সমবায়কে সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে বহুমূখী সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে গ্রাম অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তারই ফলশ্রুতিতে তিনি ১৯৭৩ সালে মিল্কভিটার মত সমবায় প্রতিষ্ঠান গঢ়ে তুলেছিলেন । তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপেক্ষিতে গণমূখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে হবে।” কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা ৭৫ সালের ১৫ আগষ্ঠ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে এদেশের সমবায় কেন্দ্রিক অর্থনীতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে থামিয়ে দেয়।
আধুনিক বাংলাদেশের রুপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ বছর পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে সমবায় নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহন ও সমবায় ভিওিক বিভিন্ন প্রকল্প নেন। এসকল প্রকল্প ও উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১,৭৪,৬০০ সমবায় সমিতি বিদ্যমান আর এ সকল সমবায় সমিতিতে প্রায় ১ কোটির ও অধিক সমবায়ী রয়েছে যার ১৮ শতাংশ নারী সমবায়ী। এই বিশাল সংখ্যক সমবায়ীকে একই সুতায় বেধে রেখেছে সমবায় দর্শন । আর এ দর্শন আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। সমবায়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব দরবারে উচু স্থানে নেওয়া সম্ভব। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭ টি এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে সমবায় অত্যন্ত কার্যকর উপায়।বর্তমান সরকার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন সেখানে সমবায়কে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা আরোও টেকসই হবে । সরকার বিগত দিনে দারিদ্র্য দূরীকরণে যে সাফল্য দেখিয়েছে তা ধরে রাখার জন্য সমবায় ভিওিক পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে।
এ দেশের সমবায় কৃষকদের কৃষি ঋন প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।তৎকালীন সময়ে সমবায়ী কৃষকরা এ ঋণ গ্রহন করে কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করে।বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক দেশের অতি পুরাতন ব্যাংক হওয়া স্বত্বেও বর্তমানে ব্যাংকটিকে স্পেশালাইজড ব্যাংক/ তফসিলি ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি ফলে সমবায় সমিতগুলো তাদের বিভিন্ন কাযক্রমে বড় পরিশরে কোন ঋন সুবিধা পাচ্ছে না। সমবায় ব্যাংকটিকে সত্যিকারের সমবায়ীদের ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গতিশীল করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর সমবায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব। এছাড়াও দেশর সকল জেলা/উপজেলায় সরকারি ও সমবায়ী মালিকানায় যে সকল সম্পদ রয়েচে তা উদ্ধার করে এখনই সরকারী ও সমবায় মালিকানায় সমবায় হাসপাতাল, সমবায় বিপনীবিতানসহ বিভিন্ন সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মানে সমবায় দৃশ্যমান হবে।
এক নজরে বাংলাদেশের সমবায়
১ মোট সমবায় সমিতির সংখ্যাঃ ১,৭৪,৬০৪ টি
২ ব্যাক্তি সদস্য সংখ্যাঃ ১ কোটি ৮ লক্ষ ৩৪ হাজার ৭৫০ জন
৩ কার্যকরী মূলধনঃ ১৩ হাজার কোটি টাকা প্রায়
৪ সমবায়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানঃ ৯,২১,৮৪৬ জন
৫ জাতীয় পযায়ে ১টি সমবায় ব্যাংক ,১ টি কো-অপারেটিভ ইন্সুরেন্স,
৬ বিসিএস (সমবায় )কর্মকর্তাঃ ১৯২ জন
৭ সমবায় একাডেমি ১ টি ও ১০ টি আঞ্চলিক সমবায় শিক্ষায়তন
৮ মোট জনবলঃ ৫০০৪ জন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় পন্য অত্যন্ত জনপ্রীয় কারন একমাএ সমবায়েই রয়েছে ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর অংশগ্রহন তাই এই দর্শনে এই দুই পক্ষই সুবিধা লাভ করতে পারে। ইন্ডিয়ার আমুল, ডেনমার্কের আরলা ফুড,বাংলাদেশের মিল্কভিটা সাড়াবিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত কারন এই পন্যগুলো সমবায়ীপন্য যেখানে উৎপাদনকারী ও ভোক্তার সংযোক রয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামের কৃষকরা শ্রমিক সংকটের কারনে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে । এই সংকট উওরনে সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ অত্যন্ত কাযকর। দেশের প্রত্যেকটি গ্রামে একটি করে কৃষি উৎপাদন ও বিপনন সমবায় প্রতিস্ঠান গড়ে তুলে গ্রামের সকল জমি ঐ সমিতিকে দিলে ঐ সমিতির উদ্যোগে চাষাবাদ, উৎপাদন ও বিপণন করলে এর সুফল অর্থনীতেতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে । সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এছাড়াও সমবায় ভিওিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন আমার গ্রাম আমার শহর ,সমবায় উদ্যোক্তা সৃষ্টি প্রকল্প গ্রহনের মাধ্যমে দেশের আমুল পরিবর্তন করা সম্ভব। এই সকল কাজের জন্য সমবায় অধিদপ্তরকে আরোও গু্রুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র দূরিকরনের জন্য সমবায় ভিওিক আশ্রায়ন প্রকল্প, সুবিধা বঞ্ছিত মহিলাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সমবায় ভিওিক ঋন কাযক্রম প্রকল্প ,ক্ষু্দ্র নৃতাওিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প দিয়ে এদেশ হতে চিরতরে দারিদ্র দুরকরার দৃঢ় সংকল্প করেছেন। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প যদিও সমবায় ভিওিক নয় কিন্তু সমবায়ের ধারনার আলোকেই করা হয়েছে যা এদেশের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।
সমবায় সমিতিগুলো ৭ টি মুলনীতির আলোকে পরিচালিত হয়ে থাকে যা অনুসরন করলে একটি সমবায় সমিতি অব্যসই সফলতা অর্জন করবে।
এই ৭ টি মূলনীতির মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা ও স্বচ্ছতা এদেশের পেক্ষাপটে অত্যন্ত চ্যালেন্জিং এছাড়াও গণতন্ত্র ,বিশ্বস্ততা, সহযোগিতা ,সামাজিক নিরাপওা ও শৃঙ্খলা সহজেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। সমবায় অধিদপ্তর সমবায় সমিতিগুলোর নির্বাচন, অডিট, বার্ষিক সাধারন সভা স্বচ্ছতার সহিত মনিটরিং করতে পারলে এদেশের সমবায় সেক্টর অন্য সেক্টরের ন্যায় কাযকর হয়ে উঠবে। নিবন্ধিত সমবায় সমিতিগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় সমবায় ইউনিয়ননের সদস্য হিসেবে অর্ন্তরভুক্ত করতে হবে। জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন সমবায়ীগনকে সমবায় সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষন প্রদান করে আগামির নেত্বৃত্ব দিতে সক্ষম সমবায়ী তৈরী করতে হবে। সমবায় অধিদপ্তর অতি প্রাচীন একটি বিভাগ সে তুলুনায় এর সংষ্কার ,জনবল কাঠামোর আপগ্রেডেশন ও সমবায় অধিদপ্তরকে শক্তিশালীকরন করা হয়নি কারন সমবায়ের সাথে পুজিবাদের দ্বন্দ বিদ্যমান। সমবায় অধিদপ্তর ও সমবায় ক্যাডারকে সংষ্কার করে নতুন রুপে ঢেলে সাজানো গেলে এদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সুবাতাস বইবে।
প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শনিবার জাতীয় সমবায় দিবস পালন করা হয়ে থাকে। এ বছর জাতীয় সমবায় দিবসের মুল প্রতিপাদ্য নির্ধারন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দর্শন,সমবায়ে উন্নয়ন । বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মানে সমবায়ের এ দর্শনকে ধারন করে ২০২১ সালের মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মানে সমবায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
মোঃ আবুল খায়ের
উপ নিবন্ধক (ইপি)
বিসিএস (সমবায়)
সমবায় অধিদপ্তর, ঢাকা।
ও
ট্রেজারার,৩১ তম বিসিএস অল ক্যাডার এসোসিয়েশন