সমবায়ের ৭টি মূলনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে আন্ত:সমবায় সম্পর্ক। বাংলাদেশে সমবায়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সমবায় আন্দোলন এগিয়ে চলছে। সমবায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সদস্য অন্তর্ভূক্তি বেড়েছে, মূলধন বিস্তৃত হয়েছে, কর্মসংস্থানের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়, দেশের এমন কোন পেশা নেই যেখানে সমবায় নেই, এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এর সবই পরিমাণগত বিস্তৃতির নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সমবায়ের গুনগত বিস্তৃতির যাত্রাটি অনেক ক্ষেত্রেই আশাপ্রদ নয়। সমবায়ীরা সমবায় সম্পর্কে কাঙ্খিত মাত্রায় প্রশিক্ষিত নয়, নেতৃত্ব শক্তিশালীরূপে গড়ে ওঠে নি, সাফল্যের ডকুমেন্টেশন ও প্রচারেও দুর্বলতা রয়েছে, শুদ্ধাচারে ঘাটতি আছে, সর্বোপরি দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া Public-Cooperative Partnership এখনো আলোর মুখ দেখে নি। সমবায়ের অগ্রযাত্রায় যে বিষয়টিতে বাংলাদেশে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে তা হ’ল সমবায় নেটওয়ার্কিং। এটি বর্তমান বিশ্বে সমবায় সাফল্যে অন্যতম চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দেশে তিন স্তর এবং দ্বিস্তরভিত্তিক সমবায় বিদ্ধমান রয়েছে।
কিন্তু এসকল সমবায়ের Horizontal এবং Vertical Relationship তেমন শক্তিশালী নয়। একই সাথে প্রাথমিক সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে অন্ত:সম্পর্ক এবং আন্ত:সম্পর্ক তেমন মজবুত নয়। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সমবায় সমিতি এবং সমবায়ী ভাল উদ্যোগ এবং সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও সমবায় নেটওয়ার্কিং এর প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি থাকায় একদিকে সাফল্যের দৃষ্টান্তসমূহ অন্য সমবায়ী কিংবা সমবায় সমিতি শেয়ার করতে পারছে না আবার সাফল্য অর্জন সংক্রান্ত কার্যক্রমসমূহ টেকসই হচ্ছে না।
শুধু দেশেই নয় Cooperative Networking এমন এক ধারণা যা বিশ্বের সকল সমবায়কে একটি Cooperative Village এ আবদ্ধ করে। অনুন্নত, স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশসমূহে সমবায়ের রয়েছে বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা, সাফল্য-ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত, উদ্ভাবন ও কারিগরি দক্ষতা, সাংগঠনিক সক্ষমতা বিষয়ক নানাধরণের উদাহরণ। Cooperative Networking প্রতিষ্ঠিত হলে এসকল উদাহরণ শেয়ারিং এর মাধ্যমে দেশীয় সমবায় প্রতিষ্ঠান এবং সমবায়ীরা নানাভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ পাবে।
The Global Cooperative Network
সমবায় নেটওয়ার্কিং শুধু যে অভিজ্ঞতা শেয়ারিং এর প্লাটফর্ম হবে তা নয়, একই সাথে সমবায় পণ্যের বাজারজাতকরণ, পুজিঁ সংগ্রহ, Technology Transferসহ আরও অন্যান্য বিষয়ে সমবায় আন্দোলন সমৃদ্ধ হতে পারবে। সমবায় নেটওয়ার্কিং এর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হচ্ছে Public-Cooperative Partnership। এর অর্থ হচ্ছে সরকার সমবায় অংশিদারিত্বের মাধ্যমে এমন কিছু অবকাঠামো তৈরি করা যা সমবায়ীদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশে শুধুমাত্র মিল্কভিটার ক্ষেত্রে এধরণের পার্টনারশীপ ভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায়ীরা দুগ্ধ উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণে সুফল পাচ্ছে। মিল্কভিটা Public-Cooperative Partnership এর দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে যে ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তা অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও বিস্তৃত করার সুযোগ রয়েছে। যেমন: মৎস, পোল্ট্রি, মাংস, অপ্রধান শস্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে Public-Cooperative Partnership ভিত্তিক প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এর সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য অনেকেই আশংকা করতে পারেন এ সকল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে, এখানে সমবায় অধিদপ্তরের সেই ম্যান্ডেট নেই। এ আশংকাটি মোটেই যুক্তি নির্ভর নয়। কেননা মৎস, পোল্ট্রি, মাংস ও অপ্রধান শস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ ক্ষেত্রে সমবায় অধিদপ্তর Cooperative Approach এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এ বিষয়ে সমবায় অধিদপ্তর ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। সুতারাং মিল্কভিটার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দ্রুত উল্লেখিত ক্ষেত্রসমূহে Public-Cooperative Partnership ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বেজা কাজ করে যাচ্ছে। অথচ একটিও সমবায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমবায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অনেক জমিও রয়েছে, যেমন: কক্সবাজারের বদরখালী সমবায় সমিতির বিস্তৃত জমি রয়েছে যেখানে একটি সমবায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এছাড়াও টাঙ্গাইল, দিনাজপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিভিন্ন সমবায় সমিতির মালিকানাধীন জমি রয়েছে। এসকল জমিতে বেজার তত্ত্বাবধানে সমবায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে দেশী ও আন্তর্জাতিক Cooperative Networking Platform তৈরির মাধ্যমে সমবায় ভিত্তিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ প্রক্রিয়ায় বিপুল সংখ্যক সমবায়ীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যাবে,পাশাপাশি আন্ত:সমবায় সম্পর্ক নিবিড় করার মাধ্যমে সমবায় পন্যের ব্রান্ডিং,প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ সম্ভব হবে।
Cooperative Networking সমবায়ীদের মধ্যে সামাজিক বন্ধনকেও সুদৃঢ় করবে। তাদের মধ্যে আন্ত:সহযোগিতা, সহমর্মিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সমবায়ী সামাজিক গোষ্ঠি তৈরী হবে, যা পরবর্তীতে সমবায় পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে, সামাজিক অবক্ষয় রোধে এবং টেকসই পরিবেশ সৃষ্টিতে সুসংগঠিত গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হবে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে Cooperative Networking এর Horizontal এবং Vertical Relationship ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, দেশের পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া উপজেলার একটি টমেটো উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। সমিতির সকল সদস্য উৎপাদনের কারিগরি দিক, প্যাকেজিং ইত্যাদি বিষয়ে একে অপরের অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং নানাধরনের কৌশল শেয়ারিং এর মাধ্যমে উৎপাদন দক্ষতা ও গুণগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। একই ভাবে পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় একই ধরণের সমবায় সমিতি গুলো পারষ্পরিক তথ্য বিনিমিয়, অভিজ্ঞতা শেয়ারিং, কলা-কৌশলগত প্রশিক্ষণ এর মাধ্যমে উৎপাদন দক্ষতা ও মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে পারদর্শি হওয়ার সুযোগ পাবে। এই Horizontal Relationship শুধুমাত্র পঞ্চগড়ে নয়, দেশের প্রতিটি জেলার সমধর্মী প্রাথমিক সমবায় সমিতি এবং সদস্যদের মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব, যা সমবায় আন্দোলনের ভিত্তিকে মজবুত করবে। Horizontal Relationship এর পাশাপাশি Vertical Relationship-ও Cooperative Networking এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া উপজেলার টমেটোসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি ও সদস্যদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রদানের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গড়ে উঠতে পারে।
এ সমবায় সমিতির মূল কাজ হবে আঞ্চলিক পর্যায়ে সমবায়ীদেরকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ সহায়তা প্রদান, পুজিঁ সরবারহ ইত্যাদি। এধরনের নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে সমবায়ীরা শুধুমাত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও উৎকর্ষতা নিয়ে ভাববে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি উৎপাদন পূর্ববর্তী উপকরণ সরবরাহ এবং উৎপাদন পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে কাজ করবে। ফলে Cooperative Networking এর মাধ্যমে একটি গতিময় সমবায় অর্থনীতি কার্যকর হওয়ার সুযোগ পাবে। কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিসমূহের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় সমবায় সমিতি গঠিত হলে উক্ত সমবায় সমিতি সমবায় পণ্যের আন্তর্জাতিক ব্রান্ডিং, রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে Cooperative Networking প্রতিষ্ঠা,জাতীয় পর্যায়ে সমবায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশীয় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্ণিত Cooperative Networking মডেল কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একদিকে সমবায়ের অবদান বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে, পাশাপাশি শক্তিশালী সমবায় নেটওয়ার্কিং এর দ্বারা সমবায়ীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সমৃদ্ধ হবে। সর্বোপরি বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় একটি পরিশীলিত, গতিময় সমবায় অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।