তাদের কারো বাড়ি রংপুর, কারো কুমিল্লা, কারো আবার বিক্রমপুরে। নদী ভাঙ্গনে কেউ জমিজমা হারিয়ে, কেউ স্বামী ভাত দেয় না বলে, কেউ বাবা-মা নেই বলে চলে আসেন ঢাকায়। মানুষের বাড়িতে কাজ করে আজ শতাধিক গৃহকর্মী অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। জমি কিনে কেউ নতুন বাড়ি করেছেন। কেউ গরু কিনেছেন, কেউ আবার ছেলে-মেয়েকে দুই তিন লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছেন। আর এই দিন বদলে তাদের সহায়ক হয়েছে সমবায় সমিতি। মাসে সামান্য কিছু টাকা সঞ্চয় করে অল্প কিছু লাভ দিয়ে সমবায়ের মাধ্যমে তারা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের মর্যাদা।
রোকেয়া পদক প্রাপ্ত গোলাপ বানুর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তিনি প্রত্যেক নারীর কাছ থেকে এক মুষ্ঠি চাল সংগ্রহ করে গড়ে তোলেন সমবায়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতি লিমিটেড প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গোলাপ বানু অর্জন করেন ২০১৪ সালের রোকেয়া পদক। এমন অনেক নারীই আজ ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও ইসলামপুর এলাকায় ঝিয়ের কাজ করে সমবায়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করেছেন নিজেদের। তাদের জন্য অনুসরণীয় এই গোলাপ বানুর কথা জানা না থাকলেও সমবায়ের সুফল তারা পেতে শুরু করেছেন।
মোর্শেদা স্বামী হারা হয়ে বিশ বছর আগে আসেন ঢাকায়। শুরুতে কয়েক শ টাকা বেতন পেলেও আজ তা দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজারে। মাসে পাঁচশ ও এক হাজার টাকার দুটি সঞ্চয় করেছেন তিনি। এরই মধ্যে রংপুরের বদরগঞ্জে বাড়ি করেছেন। মেয়ের ঘর সাজিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। মোর্শেদা ইসলামপুরের নবাব বাড়ি এলাকায় এক বাড়ির ছাদে থাকেন। শুধু মোর্শেদা নন একই জেলার মোমেনা, সালেহা বেগম, আমেনাসহ বেশ কয়েকজন সেই ছাদে রোদবৃষ্টির সাথে যুদ্ধ করে বাড়িভাড়া বাঁচিয়ে সঞ্চয় করছেন। তারা যুক্ত হয়েছেন কেরানীগঞ্জ এলাকার খেটে খাওয়া মঞ্জু, মনিকা, লাভলি, ময়না বেগমের মতো সমবায় করা শতাধিক নারীর সাথে।
আমেনা বেগমের কোন অক্ষর জ্ঞান নেই। দশ টাকার ছবি দেখে বলতে পারেন, এটা দশ টাকা আবার দশটা মিলিয়ে করেন একশ টাকা। একশ টাকার দশটা মিলে যে হয় এক হাজার তাও তার জানা। কিন্তু কেউ যদি অন্য নোট দেন, কিংবা এক তারিখের জায়গায় দশ তারিখে বেতন দেন তা আমেনা ধরতে পারে না। এমন অজ্ঞ আমেনাই দুইটি সমিতি করে মাত্র কয়েক বছরে সঞ্চয় করেছেন ৭০ হাজার টাকা। আমেনার স্বপ্ন ছেলেমেয়ের জন্য আড়াই লাখ টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়িতে ঘর করা। আমেনা জানান, যে বাড়িতে তিনি ঠিকা ঝিয়ের কাজ করেন সেই বাড়ির মালিকই তাকে সমবায়ের পরামর্শ দেন। সালেহা বেগম ষাটোর্ধ বয়সে মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলেদের সংসার চালান। ছেলেরা সেই টাকা থেকে মায়ের নামে সমিতি করেন রংপুরে। আজ আর তাদের দুঃখের দিন নেই। সালেহা বলেন, মাসে ছয় হাজার টাকা কামাই করি এক টাকাও খরচ করি না। মানুষের বাড়ির ছাদে থাকি। যে যা দেয় তা খাই। না পেলে, না খেয়ে থাকি। কিন্তু টাকা খরচ করি না। টাকার জন্যই তো পরিবার ছেড়ে ঢাকায় এসেছি। আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বেশি খরচের মতো অবস্থা নেই। আর কয় দিনই বা কাজ করতে পারবো। তখনতো এই টাকার ওপরই ভর করে চলতে হবে।
আমেনা জানান, মাসে ১৫শ টাকা করে এক বছরে তাকে ১৮ হাজার টাকা দেয়া হয়। সমিতি ভাঙ্গার দিন মোরগ পোলাও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শতকরা ৫ টাকা হারে তাদের মুনাফা হয়। তারা ৩শ টাকা থেকে শুরু করে হাজার পনের শ টাকা পর্যন্ত জমা দিয়ে সমবায় সমিতি করেছেন। পাঁচ বছর, দুই বছর এবং সর্বনিম্ন এক বছর মেয়াদী এই সকল সমবায়ে তাদের শতকরা তিন টাকা হারে মুনাফা থাকে বলে জানান কয়েকজন। এরশাদ বেপারি বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ঝাউবাড়ি বসবাস করেন। তার কাছে পঞ্চাশের অধিক নারী টাকা জমা করেন। এরশাদের কাছে টাকার কোন হেরফের হয় না বলে জানান ময়না বেগম। গরু কিনে জবাই করে ভাগা দিয়ে বিক্রি করেন এরশাদ বেপারি। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি এই সমবায় পরিচালনা করছেন। মানুষ বিশ্বাস করে তার কাছে টাকা রাখে।
তবে বিশ্বাসের মর্যাদা অনেক সময় রক্ষা হয় না বলেন রংপুরের তারাগঞ্জের মোহেসেনা বেগম। ঢাকায় এসে তিনি প্রথম যে সমিতি করেছিলেন সেই সমিতির টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে এক প্রতারক। তাই বুঝে শুনে ভাল মানুষের সাথে সমিতি করার পরামর্শ দেন তিনি।