বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের একটি সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথপরিক্রমা রয়েছে। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হয়েছে। সমবায় শুধু একটি উন্নয়ন দর্শনই নয়, এটি আর্থসামাজিক আন্দোলনও বটে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে এ আন্দোলন চলমান রয়েছে।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুরো বাংলাদেশকে একটি শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যখন স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন সারা দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। দেশের এক কোটি মানুষ তখনো ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং কোটি কোটি অসহায়গ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসন করা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনরায় চালু করা এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া মিল-কারখানা চালু করাসহ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার মতো কঠিন দায়িত্বভার তাকে গ্রহণ করতে হয়।
তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে সমবায়ের ডাক দিয়েছিলেন। দেশের বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ জনগণ, যারা হতদরিদ্র এবং অশিক্ষিত, তাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সমবায়কে একমাত্র অবলম্বন হিসেবে তিনিই প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে গিয়ে তার গভীর পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এল অমিত সম্ভাবনাময় এ দেশের মাটি ও মানুষ। পরিবেশ ও প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় সম্পদ। যেহেতু বঙ্গবন্ধু এ দেশের মাটি ও মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন।
তাই এ সম্পদকে যথার্থ কাজে লাগাতে এবং দেশ গঠনের নিয়ামক হিসেবে এক পর্যায়ে গ্রহণ করলেন সমবায়ভিত্তিক কর্মযজ্ঞ। দেশকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে এবং মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ, সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুযোগ সুবিধা দান নিশ্চিত করার গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে দেশের উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিগুলোর মালিকানার ক্ষেত্রে সমবায়ী মালিকানাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মালিকানা খাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
তিনি ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের শোভাযাত্রায় সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে সরকার বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্নমুখী সমবায় চালু করবে।’ এ ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সমবায়ের মাধ্যমে দেশের সম্পদকে সুষমভাবে ব্যবহারের জন্য জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেন।
এর মূল লক্ষ্য ছিল তত্কালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করা এবং দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন আনাপূর্বক সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করা। এ প্রসঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন—গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কোঅপারেটিভ করা হবে এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে কোঅপারেটিভ করার বিষয়টি সন্নিবেশিত হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কিছুসংখ্যক কুচক্রী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাতের আঁধারে জাতির জনককে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।
আশা করা যায়, বাংলাদেশের সম্পদ সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ অচিরেই সোনার বাংলায় পরিণত হবে। পাক-ভারত উপমহাদেশে সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস বেশ পুরনো। তবে তথ্যমতে, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০৪ সালে প্রথম কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটিজ অ্যাক্ট সর্বপ্রথম জারি করা হয়। এর পর থেকে সারা ভারতে সমবায় আন্দোলন বিকাশ লাভ করতে থাকে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে সমবায় আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে বহু প্রতিষ্ঠান তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফলতা পেয়েছে, যার মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিপুলভাবে উপকৃত হয়েছে, এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ দ্য চিটাগং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড। এই সমবায়ী প্রতিষ্ঠানকে ৬৯ বছরের অগ্রযাত্রায় সফল কর্মকাণ্ডের জন্য ২০১৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতীয় সমবায় পুরস্কারে ভূষিত করেন। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সমবায় ভাবনা ও উন্নয়ন দর্শন একান্তই প্রাসঙ্গিক।